জন ফোর্ড থেকে ক্লিন্ট ইস্টউড — হলিউডের ওয়েস্টার্ন ছবির দিকপালরা যে রোমহর্ষক সময়কে হাজির করেছেন পর্দায়, এ বই ঠিক সেই সময়কাল আর ভৌগলিক প্রেক্ষিতের বাস্তব ছবি।
এবার বইটার পিছনের কভারটা একটু ভালো করে দেখুন। ওই লালা দাগটা মিসোরি নদী, নীচে নেমে মিসিসিপির সঙ্গে মিশেছে। ওর বাঁদিকটার গোটাটাই হলিউড ওয়েস্টার্নের ‘ওয়াইল্ড ওয়েস্ট’। মার্কিন মুলুকের দুই-তৃতীয়াংশ। ওটা অবিশ্যি স্মরণাতীতকালে মোটেই ‘ওয়াইল্ড’ ছিল না। ছিল শতশত আদিবাসী গোষ্ঠীর অবাধ বাসভূমি। পরে যাঁদের দেগে দেওয়া হল ‘রেড ইন্ডিয়ান’, ‘নোটিভ আমেরিকান’, ‘আমেরিকান ইন্ডিয়ান’ ইত্যাদি নামে। সেখানে উদার প্রকৃতির অংশ ছিলেন তাঁরা। গভীর জঙ্গল, ধুধু প্রান্তর, বিশাল সব নদী, বরফ-ঢাকা পাহাড় থেকে তাঁরা নিতেন দিব্যি বেঁচে থাকার রসদ। ততটুকুই, যতটাতে দিব্যি বেঁচে থাকা যায়।
ওই লাল দাগ, মানে মিসোরি নদীর ডান পাড়ে, মানে পূবে, বেশ কয়েক শতক আগেই আরও পূবের অতলান্তিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে শ্বেতাঙ্গরা হাজির হয়ে সেখানের আদিবাসীদের খতম করে পুঁজিবাদের ধাঁচায় একটা সমাজ গড়ে ফেলেছিলেন। এল উনিশ শতক। পূবের অতলান্তিক থেকে মিসোরি নদীর মধ্যে গড়ে ওঠা সমাজে আর ঠাঁই হচ্ছিলনা হাজারে হাজারে শ্বেতাঙ্গর। লবন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছিল কঠোর পরিশ্রমের পরেও। ইতিহাসের নানা মারপ্যাঁচে তাঁদের সামনে এল এক অদ্ভুত বিকল্প — মিসোরি পার করো। বলদ গাড়ি কেন। বাপ-মা-ভাই-বোন-বউ-বাচ্চাকে চাপাও। পাড়ি লাগাও প্রায় সম্পূর্ণ অচেনা, পথবিহীন পশ্চিমে। ৩৫০০ কি.মি. পার করে একেবারে পশ্চিমের প্রশান্ত মহাসাগরের পাড়ে, বা তার আগেই যেখানে খুশি জমি ঘিরে নাও, বসবাস শুরু করো। এ দুধ-মধুর দেশ। নদীর বালিতে সোনা ছড়ান দেশ— চার্লি চ্যাপলিনের গোল্ড রাশ! কিংবা চাষ করো। কিংবা চুটিয়ে গো-পালন। র্যাঞ্চ। সেই গরুর দুধ বেচ স্থানীয়দের। গরু চালান করে দাও পূবে, জবাই করে মাংস তৈরির জন্য। কাউবয়দের তো তাই কাজ— শতশত গরু তাড়িয়ে কাছের হাটে নিয়ে যাও শতশত মাইল পার করে। যে হাটে এসে দাঁড়ায় সপ্তাহে কয়েকবার দারুণ ধোঁয়া ছড়ান নড়বড়ে রেলগাড়ি, পূব থেকে। গরু আর শস্য বোঝাই হয়ে ফিরে যায়।
মুশকিল হল, দুটো। ৩৫০০ কি.মি. পথ পার বলদ গাড়িতে? চেন্নাই থেকে লাদাখ? সম্ভব? সম্ভব করেছিলেন লক্ষ লক্ষ শ্বেতাঙ্গ। পথেই মারা গিয়েছিলেন হাজারে হাজারে। মূলত রোগে। দ্বিতীয় মুশকিল, এই যে দেখে-শুনে-বেছে জমি ঘিরে নিলেই হল, এ তো মার্কিন সরকারের নিদান। আসলে তো এ জমি আদিবাসীদের। প্রথমে তাঁরা বোঝেনইনি। দু-বাহু খুলে আপ্যায়ন। তারপর যখন আছড়ে পড়তে থকাল শ্বেতাঙ্গদের ঢল, দমকে দমকে, বেদখল হয়ে যেতে লাগল জল-জঙ্গল-জমিন, রুখে উঠলেন তাঁরাও। হামলা বোল। শেতাঙ্গ শিবিরে। অতি উন্নত অস্ত্রে ভরপুর মার্কিন সেনা সঙ্গে নিয়ে পাল্টা মার শুরু হল শ্বেতাঙ্গদের। হলিউড পেয়ে গেল তার ‘ওয়াইল্ড ওয়েস্ট’।
সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ হয়ে উঠলেন যুদ্ধবাজ— পুঁজিবাদের জাঁতা কলে পড়ে। এরই মধ্যে কালো মানুষ দাসদের লেখাপড়া শেখানো আর রোজগারের লোভ দেখিয়ে মার্কিন সরকার খান দুয়েক সেনা দলই তৈরি করে ফেললেন তাঁদের দিয়ে। অফিসাররা শ্বেতাঙ্গ অবিশ্যি। বাফেলো সোলজার্স — নাম আদিবাসীদের দেওয়া, কাজ— শ্বেতাঙ্গদের হয়ে আদিবাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ করা।
আশ্চর্য এই সময়। আশ্চর্য তার রকম সকম। আঙুল তোলা সোজা, কিন্তু বাস্তব অনেক জটিল। হলিউড ওয়েস্টার্নের মতো রোমহর্ষক বটে, কিন্তু মোটেই তেমন সোজা সাপটা নয়। তা হলে কেমন? লেখক খুঁজে বার করলেন একের পর এক বই। যার মধ্যে ছিল পাঁচটি স্মৃতিকথা। আরও ভেঙে, বহু ম্যাপ দিয়ে বোঝান আছে গোড়ার দীর্ঘ ভূমিকায়।
শেষপাতে জুড়ে দিয়েছেন সেই সব আগুন দিন কালের ওই অঞ্চলের কিছু খানা, কিছু পিনা-র কিস্সাও।