Hardcover, Tushar Talukdar, History & Politics, Essays, Memoir
মানুষ চেনা বড় সহজ কাজ নয়। কোনো মানুষের সাথে যুগের পর যুগ কাটিয়েও তাকে চেনা দায়। আবার কারও সাথে মুহূর্ত কয়েকের আলাপই যথেষ্ট। অফিস কাছারিতে যে বড়বাবুটি গম্ভীর রাশভারী ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, তার মানেই তিনি মানুষটি খারাপ এমন সরলীকরণ অহেতুক। বরং কাজের থেকে অকাজেই মানুষের আসল চেহারা ধরা পড়ে। কাজের কথার থেকে এলোমেলো কথাই আসলে মানুষের মুখ।
একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করি। গবেষক প্রফুল্লকুমার চক্রবর্তী উদ্বাস্তুদের নিয়ে তাঁর বিখ্যাত গবেষণাগ্রন্থ লিখছেন তখন। হন্যে হয়ে সরকারী দপ্তরে ঘুরে বেরিয়েছেন সরকারি দলিল দস্তাবেজ দেখার জন্য। সরকারি দপ্তরগুলো থেকে অবশ্য দুর্ব্যবহার, অসহযোগিতা ছাড়া কিছুই মেলেনি। গবেষণা প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড়। এমন সময় একদিন প্রফুল্ল বাবুর বাড়িতে এলেন অধ্যাপক বন্ধু সুখেন্দু চক্রবর্তী। তিনিই প্রফুল্ল বাবুকে নিয়ে গেলেন এক 'কাজ'এর মানুষের কাছে। মানুষটি সরকারি দপ্তরের উচ্চপদস্থ আমলা। বেশ রাশভারী গোছের। প্রচুর ক্ষমতাবান মানুষ। তিনি ইচ্ছে করলে উদ্বাস্তু সংক্রান্ত সমস্ত গোপন ফাইল মুহূর্তে হাজির করতে পারেন টেবিলে, কিন্তু হাত তুলে নিলে আর কিছু করবার নেই। প্রফুল্ল বাবুর গবেষণা সংক্রান্ত সব কথা অনেক্ষন খুঁটিয়ে শুনলেন। বললেন-ওমুক দিন ওমুক সময়ে দেখা করতে। একে সরকারী ক্ষমতাশীল আমলা। তা রউপর এমন গুরুগম্ভীর। প্রফুল্ল বাবু খুব আশা রাখলেন না। যাই হোক, নির্দিষ্ট দিনে উপস্থিত হলেন আমলার অফিসে। প্রফুল্ল বাবু তো অবাক। তাঁর সামনে ডাই করে রাখা তাঁর কাঙ্খিত সব সরাকরি রিপোর্ট। ক্রমে সেই 'কাজের' মানুষটি হয়ে উঠলেন প্রফুল্ল বাবুর কাছের মানুষ। সরকারী আমলাও যে এমন মানবিক হতে পারেন, প্রফুল্ল বাবু তো অবাক! একটু করে চিনেছিলেন কঠিন সরাকরি দায়িত্বের বর্মের আড়ালে এক সুকুমার মানবিক বন্দুত্বপূর্ন হৃদয়কে। আর সেই কাজের মানুষটি তাঁর গভীর প্রজ্ঞায় অনুভব করেছিলেন প্রফুল্ল বাবুর অধ্যবসায়।
এমন কাজের মানুষই যখন কাজ থেকে অবসরের পর কলম ধরেন, তখন যে তা সুখপাঠ্য হবে সে বলা বাহুল্য। সেই কাজের মানুষটি তুষারকান্তি তালুকদার। পশ্চিমবঙ্গের এক সময়কার দুঁদে পুলিশ কমিশনার। যেমন চিরদিন অবিচল সৎ থেকেছেন নিজের কর্তব্য কর্মে, তেমনই বলিষ্ঠ লেখনীতে করেছেন বিচিত্র সব স্মৃতিচারণ। বিশ্লেষণ করেছেন একজন আমলার তীক্ষ্ণ যুক্তিতে অথচ সে দৃষ্টিভঙ্গি সর্বত ভাবে মানবিক। গভীর পান্ডিত্যরসে ভরপুর। নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে জ্ঞান চর্চা ছাড়া তা সম্ভব নয়। সেই জ্ঞান চর্চার বুনিয়াদ তৈরী হয়েছিল তালুকদার মহাশয়ের যুবা বয়সেই। পড়ছেন প্রেসিডেন্সিতে অর্থনীতি নিয়ে। সেই সাথে সাহিত্যচর্চা। শক্তি সুনীল তখন তরুণ তুর্কি। আড্ডা জমান তাঁদের সাথে। পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। মনে প্রছন্ন এক আশা ছিল সাহিত্য সাধনার। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারে সরস্বতীর সাধনা অপেক্ষা লক্ষীর সাধনা জরুরি। অতএব আমলার পরীক্ষায় বসা। আইপিএস। প্রথম বারেই সসম্মানে উত্তীর্ন। শুরু হল চাকরী জীবন। অনেকটাই দূরে এসে পড়লেন সাহিত্য জগৎ থেকে। কিন্তু সাহিত্যের ভূত যাকে একবার ধরেছে তার নিস্তার নেই। অতএব চাকরির ফাঁকেই চলল সরস্বতীর সাধনা। রাহুল সাংকৃত্যায়নের লেখনী থেকে পেলেন মার্কসবাদের দীক্ষা। রাহুল সাংকৃত্যায়নের আত্মজীবনের করেছেন বাংলা অনুবাদ। তুষারবাবু মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী অথচ কমিউনিস্ট নন। বরং এ রাজ্যের কমিউনিস্টদের বহু কার্যকলাপের সমালোচক। পুলিশের উচ্চপদস্থ পদের ব্যস্ততা, শ্রম, অন্ধকার জগৎ, দুর্নীতি থেকে সযত্নে আগলেছেন নিজের জ্ঞানের সাধনাকে। তবেই না এমন মায়া মেদুর অথচ পান্ডিত্যে ভরপুর স্মৃতিকথন লেখা সম্ভব!
তুষারবাবুর বেড়ে ওঠা থেকে চাকরীজীবন, এ রাজ্যের বহু ঘটনা- উদ্বাস্তু সমস্যা, নকশাল আন্দোলন, কংগ্রেস জামানার পতন, বাম জামানার উত্থান, পাতাল রেল, বাবরি মসজিদ ঘিরে এ শহরের দাঙ্গা বিচিত্র রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের অভাব নেই। আবার সে যুগ কিন্তু সুচিত্রা(মিত্র), কনিনীকা, জর্জ(দেবব্রত) বিশ্বাস, শক্তি-সুনীল, ঋত্বিক, সত্যজিৎ, মাদার টেরেসার যুগ। তুষার বাবুর মতন এক সংস্কৃতিবান প্ৰশাসক যখন লেখেন স্মৃতিকথন, সে গ্রন্থ হয়ে ওঠে একটা যুগের গুরুত্বপূর্ন দলিল। তাতে ভিড় করে সেকালের রাজনীতি ও সংস্কৃতির নক্ষত্ররা। ছেলেবেলার কথা, মুজতবা আলী বা লতা মঙ্গেশকরের সাথে ক্ষনিকের আলাপ, সুচিত্রা মিত্র, জর্জ বিশ্বাসের সঙ্গীতে মুগ্ধতা, মাদার টেরিসার সাথে ব্যক্তিগত পরিচয়, রাহুল সাংকৃত্যায়নের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা, কখনো বা লাল গড় কখনও লাল পতাকার উত্থান, কমিউনিস্ট নেতাদের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের সমালোচনা অথচ তাঁদের প্রতি কী নিদারুণ সৌজন্যবোধ, নিজের অফিসে রেখেছিলেন লেলিনের ছবি।সেই নিয়ে সমালোচনা কম হয়নি। তুষারবাবু নিজ সিদ্ধান্তে অটল। কখনও বা ঋত্বিক, শক্তির মাতলামি নিয়ে হাস্যরস, দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসারেদের কলমে একহাত নেওয়া, কখনও সলিল চোধুরীর সুরমাধুরিতে বুঁদ হয়ে থাকা, প্রফুল্লবাবুর গভীর অনুসন্ধিৎসাকে রাজকীয় স্যালুট... এমনই নানান স্মৃতির কোলাজ এ গ্রন্থ। সারাজীবন অপরাধ জগৎ সামলেও এমন সব বিচিত্র রসে টইটুম্বুর লেখা, লেখা যায়!! তুষারবাবুর নামের পাশে যদি 'পুলিশ প্রশাসকের তকমা না থাকত তিনি পেশাদার লেখক হলে বাংলার সাহিত্য জগৎ বলিষ্ঠ এক সাহিত্যিক পেত। পুলিশ নিয়ে আমাদের গতানুগতিক নীচু ধারণার গালে সপাটে এক থাপ্পড় কষিয়েছেন তুষারবাবু, তাঁর লেখনী দিয়ে।
Others
Publisher : Deep Prakashan
Author : Tushar Talukdar
Language : Bengali
Binding : Hardcover
Pages :
ISBN : 9789389584202