Hardcover, Sunil Sensharma, Travelogue, Memoirs
মাত্র একবছর আগে সে জায়গা ছিল এক রণাঙ্গন, ১৯৬২র নভেম্বর মাসে বিজয়ী চৈনিক বাহিনী একরকম নীরবে তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিজেদের দেশে ফিরে গিয়েছিল। সাধারণ মানুষের কাছে নেফার রহস্য তাতে আরও ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল। সেই জায়গায় পৌঁছে যে রোমাঞ্চে গা শিউরে উঠবে সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে গভীর প্রেম? ‘ছায়াবৃতা’-র পাঠক ক্রমশ বুঝবেন যে এ সত্যি এক প্রেমের কাহিনী। সে প্রেমে মনের আনন্দে গান শুনিয়েছে জিয়া ভরালি নদী, সাক্ষী হয়েছে শ্যামল পাহাড়ের সারি, আকাশছোঁয়া প্রাচীন গাছ। হলোই বা আসল কাজ রাস্তা তৈরির প্রস্তুতি, পাহাড় পর্বত ফুঁড়ে যাতে সভ্যতার রথ শিঙা ফুঁকে ঢুকে পড়তে পারে এই আদিম ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের অন্তরে— তাই বলে কি প্রেম হবে না? লেখকের নিজের কথায়— “আমরা আজকের দিনের ভগীরথ। গহন অরণ্যের মাঝে, সুউচ্চ পর্বতমালার অন্তরালে আড়াল হয়েছিল এক মানবগোষ্ঠী। এরা নিজেদের নিয়ে একটা আলাদা জগৎ গড়ে বাস করছিল সৃষ্টির প্রথম প্রভাত থেকে। আমরা আজ সেই জগতে প্রবেশ করার রাস্তার দিকনির্ণয় করছি।”
হাতে দূরবীন, গলায় কম্পাস আর কাঁধের ঝুলিতে নানা কেজো জিনিস নিয়ে প্রতিদিনের অভিযানে শিলাস্তরের রহস্যমোচন যেমন হয়, তেমনই মনের গভীরে দাগ দিয়ে যায় গম্ভীর ধ্যানমগ্ন পাহাড়, প্রাচীন অরণ্য আর সানুদেশে পুঞ্জীভূত মেঘ। লেখক দেখেন ‘বনরাজি-সমাবৃত পর্বতশৃঙ্গ–সদ্যোত্থিত মেঘপুঞ্জ–মদালস গতিভঙ্গি মন্থর।’ তাঁর চোখে মেঘ হয়ে যায় স্বর্গের অপ্সরা, যারা মাটির প্রণয়ের টানে বারবার নেমে আসে পৃথিবীতে কিছু সময়ের জন্য। সেই আদিম পর্বতশৃঙ্গ যেন বিরহী প্রণয়ী, ভোরের আলোতে প্রেয়সীকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায় আরও কিছুক্ষণ। জিপ চলে পাহাড়ের সরু পথ বেয়ে, খাড়া চড়াই-উতরাই পেরিয়ে— দৃশ্যপট বদলায়— সমতলের বাসিন্দা বঙ্গসন্তান অবাক হয়ে দেখেন চতুর্দিকে এক শ্বেতবসনা প্রকৃতি, পাইন, ফার আর ওকের বনে বরফের আচ্ছাদন— “সকলি তুষারমরুময়, সকলি আঁধার জনহীন।” কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় হাড় কেঁপে ওঠে, কিন্তু সৌন্দর্যপিপাসী চোখ গাছের ডালে বরফের স্টালাগটাইট দেখে মুগ্ধ হয়— “শতলক্ষ রঙ-বেরঙের স্ফটিকের ঝাড়লণ্ঠন যেন ঝুলছে গাছের থেকে। (….) সব মিলিয়ে যেন এক রূপকথার দেশ— যে দেশে রাজপুত্র হারিয়ে যায় স্বপ্নে দেখা কন্যের খোঁজ করতে, যে দেশে পরির রূপের মোহ টেনে নিয়ে যায় ধনীর দুলাল রাজপুত্রকে’…সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে চোদ্দো হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত সে-লা গিরিবর্তে পা রেখে সেদিন কি মনে হয়েছিল তরুণ ভূতাত্ত্বিকের সেটা আমরা অনুমান করতে পারি সহজেই। তথাকথিত সভ্য জগতের খুব কম লোকেরই সেই সময়ে ওই স্বর্গীয় দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।
এ তো গেল প্রকৃতিপ্রেমের বৃত্তান্ত। কিন্তু নেফা তো শুধু নদী, পাহাড় আর প্রাচীন অরণ্যের সমষ্টি নয়— সেখানে বাস করে নানা উপজাতি, যারা আধুনিক সভ্যতার তোয়াক্কা না করেই হাজার হাজার বছর ধরে বেঁচে আছে নিজেদের আচার আচরণ নিয়ে। সেখানে থাকে আবর (আদি), ডাফলা (নিশি), মম্পা বা মিরি উপজাতি – কাজের সূত্রে তাদের সঙ্গে দেখা হয় বিভিন্ন গ্রামে। লেখক বহু যত্নে তাদের কথা লিখেছেন, সেই সব ইতিহাস পাঠ্যবইয়ের পাতায় পাওয়া যায় না এখনো। ছায়াবৃতায় ছড়িয়ে আছে তাদের ইতিহাস, তাদের জীবনবোধ আর তাদের আতিথেয়তার পরিচয়।
নেফা অগম্য হতে পারে, ছায়াবৃতা হতে পারে, কিন্তু ইতিহাসের রথ সেই পথ দিয়েও গেছে যুগ যুগ ধরে। উত্তর-পূর্ব ভারতের জটিল ইতিহাস অথবা বিশ্বাসঘাতকতার ঘৃণ্য কাহিনী জনসাধারণের অজানা অথচ সে ইতিহাস না জানলে নেফাকে বোঝা যাবে না। লেখক সেই ইতিহাস যত্ন করে পড়েছেন এবং পরবর্তীকালে লিখেছেন ভবিষ্যৎ পাঠক গোষ্ঠীর জন্য। তাই ‘ছায়াবৃতা’-তে আমরা পাব আসাম, কাছাড়, ত্রিপুরা বা কুচবিহারের রাজত্বের খবর, নেফার বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর নাম, ধাম, বন্ধুত্ব বা শত্রুত্বের ঠিকানা। আর এসবের প্রেক্ষাপট হল অভ্যন্তরীণ আর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তৎকালীন ইংরেজ সরকারের নিরন্তর ঘুঁটি চালনা নিজেদের বাণিজ্যিক এবং রাজনৈতিক আধিপত্য আরও জোরদার করার জন্য। দেশ স্বাধীন হল ১৯৪৭ সালে। ১৯৪৯ সালে জন্ম নিল পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না আর তার ঠিক পরেই প্রতিবেশী চিন ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো কোরিয়ার যুদ্ধ নিয়ে, ভারতের সীমান্ত নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তাদের তখন নেই। উপেক্ষিতা নেফা দিনে-দিনে আরও বেশি গুটিয়ে নিচ্ছিল নিজেকে। ১৯৬২ সালে চিনের আক্রমণের পর হঠাৎ ভারত সরকারের মনে হল যে ওই বিস্তীর্ণ সীমান্তে নিরাপত্তার খুব প্রয়োজন। তাই ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজ করতে পাঠানো হলো ভূতাত্ত্বিকদের— তারা রাস্তা ঘাটের দিক নির্ণয় করার পর সেখানে উপস্থিত হবে প্রকৌশলী বাহিনী— তৈরি হবে রাস্তা, সেতু, বাঁধ যাতে অন্ধকার এবার সভ্যতার আলোক ঢুকে পড়তে পারে অনায়াসে। ছায়াবৃতা অবশ্যই নিছক ভ্রমণকাহিনি নয়, নয় এক নবীন ভূতাত্ত্বিকের দিনপঞ্জী। ‘ছায়াবৃতা’ নেফার ঘুম ভাঙানো আর ঘুম ভাঙার গল্প। রূপকথার রাজকন্যার মতো ঘুম থেকে আস্তে আস্তে জেগে উঠেছে নেফা।
Others
Language: Bengali
Binding: Hardcover
Genre: Travel & Tourism , Letters & Memoirs
Publishers: Suprokash