কমবেশি সব বাঙালি তরুণই চায় বাঁধা গতের বাইরে বেরোতে। বীজেশ সাহাও আলাদা নন। তবে বাঁধা জগতের বাইরে বেরোনোর স্বপ্নই তিনি দেখেননি। বরং সেই স্বপ্নকে মাটি ছোঁয়ানোর জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছেন। পারিবারিক ব্যবসার সাফল্যের স্রোতে না ভেসে যখন বাংলা প্রকাশনা জগতে টালমাটাল পায়ে প্রতিভাস- এর জন্ম দিচ্ছেন, তখন ভরসা বলতে বন্ধুবান্ধবদের হাত আর একবুক সাহস। সময়টা ১৯৮৫। কাজ শুরু হল। পূর্ণেন্দু পত্রীর সর্বান্তঃকরণ সাহায্যে বাংলা সাহিত্যের মাঠে নামল প্রতিভাস। সম্বল মাত্র পাঁচটা বই। রেবা মুহুরির ‘ঠুমরি ও বাঈজি’, দেবেশ রায়ের ‘স্বামী-স্ত্রী’, পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘জেগে আছি বীজে, বৃক্ষে, ফলে’, বিষ্ণু বসুর ‘বাবু থিয়েটার’, সোমেন ঘোষের ‘চলচ্চিত্রের ঘর ও বাহির’। উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, ভিন্ন ধারার গদ্য… স্বল্প পরিসরেও ভিন্ন প্রয়াস।
আমরা কখনওই চাইনি প্রতিভাস নেহাতই ব্যবসাক্ষেত্র হোক। ঠিক এই কারণেই টাকার বিনিময়ে অন্তঃসারশূন্য বই ছাপানোর কেন্দ্র হয়ে ওঠেনি প্রতিভাস। আমাদের দীর্ঘ পথচলার মাঝে এসে দাঁড়িয়েছেন বাংলা সাহিত্যের দিকপালেরা। অত্যন্ত জনপ্রিয় থেকে চূড়ান্ত বিতর্কিত… আমাদের লেখকের সংখ্যা কম নয়। হলফ করেই শুধু নয়, গর্ব করেই বলা যায় বাংলা সাহিত্য, আলোচনা, সিনেমা, সংগীত… নানা পরিসর মিলিয়েপ্রতিভাস যে পরিমাণ বই পাঠকের হাতে তুলে দিতে পেরেছে, তা সচরাচর চোখে পড়ে না। এ কথা আমরা নই, পাঠকরা বলেন।
প্রতিভাসের সতেরো বছরের অভিজ্ঞতা তখন। কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছে কৃত্তিবাস- এর। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই কৃত্তিবাস, যার পাতায় পাতায় প্রতিভাসিত হন নতুন কবি, তরুণ লেখক। শুরু থেকে শুধু বই নয়, প্রতিভাস হয়ে উঠেছে পত্রিকাদুনিয়ার অন্যতম ভরকেন্দ্র। বাঙালি মননশীল পাঠকমাত্রই জানেন, সবসময় সব পত্রিকা নিরন্তর চালিয়ে ওঠা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। কিন্তু পত্রিকা-প্রবাহ চলতে থাকে- তার জন্য পিছপা হইনি আমরা। শহর, কাফে ও কবিতা, কবিতা প্রতিমাসে, নতুন কৃত্তিবাস, কৃত্তিবাস মাসিক… সংখ্যা নেহাত কম নয়। নানা ভিন্নধর্মী অনুষ্ঠান, শহরে- জেলায় চারবছর ধরে কবিতা কর্মশালা … মুক্ত মনের চর্চার নানা পথের সন্ধান হাজির করেছি পাঠকদের সামনে, লেখক-কবিদের কাছে। কোনো পথ অবরুদ্ধ হলে নতুন পথ খুঁজে নেওয়াই শ্রেয়। সেই পথেই হাঁটি আমরা।
৩৫ বছর পেরিয়ে এসে একটা কথা বলা অবশ্যই প্রয়োজন, প্রতিভাস কারও একার জায়গা নয়। একটা স্বপ্ন ছিল, সেটার বাস্তবায়নও হল। কিন্তু সেই স্বপ্নকে ছুঁয়ে আকাশে ওড়ার যে সফর, তাতে লেখক আছেন, সমালোচক আছেন, আমাদের প্রতিভাস পরিবারের প্রত্যেক মানুষ আছেন যাঁরা একটা নামের আড়ালে কাজ করে চলেছেন অবিরাম। এবং আছেন আপনারা। পাঠক। যারা হাত না ধরলে, আলো না দেখালে প্রতিভাস তৈরি হত না। আমাদের পথ সব সময় মসৃণ হয়নি, আশা করি না ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু চড়াই-উতরাই বা নানা বন্ধুরতার মাঝে পাঠকের হাত ধরে আমাদের পথ যে দীর্ঘতর হবেই, সে অঙ্গীকার রইল।