Hardcover, Boria Majumdar, Gautam Bhattacharya, Sports Trivia, Essay, Biography
গৌতম ভট্টাচার্য ও বোরিয়া মজুমদার-এর লেখা 302 পাতার নতুন বই 'গাভাসকরের জন্ম' আমার পাঁচ দশক আগে হারিয়ে যাওয়া ফিলিপস্-এর ছোট্ট লাল ট্রানজিস্টরটা গুনে গুনে তিনশো দু'বার ফেরত দিল।
অজিত ওয়াড়েকরের ভারতের উনিশশো একাত্তরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর ইংল্যান্ডে সোনার যুগ্ম সফরের মাহাত্ম্য নিয়ে এই প্রথম লেখা বইয়ের পাতায় পাতায় নস্টালজিয়া। যুগ্ম লেখকের রচনার এমনই মাহাত্ম্য যে এই ষাটোর্ধ্ব প্রৌঢ়ের যেন গত পঞ্চাশ বছরের সব ধুয়ে মুছে তাকে কৈশোরের সূর্যালোকে ফের টেনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। গত শতাব্দীর সাতের দশকের গোড়ায় আমার মতো সদ্য কিশোরের নানান চন্দ্রোদয়ের পাশাপাশি নানান অমানিশার স্মৃতিচারণের ভরপুর রসদে ঠাসা এই বই।
যার এক জায়গায় লেখকদ্বয় লিখছে, 'ওই সময় ভারতীয় ক্রিকেট নিয়ে এমন অবস্থা তৈরি হয় গোটা দেশে যে ক্লাসে প্রফেসর হয়তো গুরুত্বপূর্ণ লেকচার দিচ্ছেন, হঠাৎ দেখা গেল কোনও ছাত্র আলতো করে ট্রানজিস্টরে কমেন্ট্রি শুনছে।
প্রফেসর তখন বকুনি দেওয়ার বদলে উদ্বিগ্নভাবে জিজ্ঞেস করতেন, "ইন্ডিয়ার স্কোর কী?"
"39 ফর থ্রি স্যর।"
"গাভাসকর আছে তো?"
পাঠক বিশ্বাস করুন, হুবহু একই অভিজ্ঞতা রয়েছে আজ থেকে পঁয়তাল্লিশ-আটচল্লিশ বছর আগে দক্ষিণ কলকাতার বিখ্যাত সরকারি স্কুলে ক্লাস সেভেন বা ক্লাস নাইন-এ পড়া এক কিশোরের। কেবল কথোপকথনটা প্রফেসর-ছাত্রর বদলে স্কুল টিচার-কিশোর ছাত্রে হত। যখন সেই স্কুল পড়ুয়া তার খাকি রঙের স্কুল ব্যাগের ভেতর সযত্নে লুকিয়ে ক্লাসে আনা টুকটুকে লাল ট্রানজিস্টরে আলতো করে কমেন্ট্রি শুনত। সে আর কেউ নয়----আমি। এবং আমি নিশ্চিত আমার মতো আরও অনেক অনেকে 'গাভাসকরের জন্ম' পড়তে পড়তে একইরকম নস্টালজিয়াক্রান্ত হবেন।
'গাভাসকরের জন্ম'-র যুগ্ম লেখকের একজনের বইয়ের ভূমিকা লেখা আর অপরজনের উপসংহার লেখার গেমপ্ল্যানিংটা চমৎকার। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে 'ভূমিকা'-র তলায় যুগ্ম লেখকের জোড়া সাক্ষর খোদাই থাকে। তাছাড়া বোরিয়া-র লেখা ভূমিকা ও গৌতমের লেখা উপসংহারের সারসংক্ষেপদ্বয়ও কী স্পষ্টভাবেই না 'গাভাসকরের জন্ম'-র আদত উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছে।
যেমন বইয়ের ভূমিকা-র একটা জায়গায় বোরিয়া লিখছেন, 'উনিশশো একাত্তর ক্রিকেটজয় একমাত্র তুলনীয় হতে পারে উনিশশো আটচল্লিশ-এর লন্ডন অলিম্পিকের হকি জয়ের সঙ্গে। স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যে ইংল্যান্ডের মাঠে ইংল্যান্ডকে ফাইনালে 4-0 হারানোটা দারুণ কৃতিত্বেরই শুধু ছিল না। তা ছিল খেলার বাইরে গিয়ে বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তরণ। হকির জয় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী খুব শক্তিশালী বিবৃতি ছিল। দুশো বছর ধরে যারা দাবিয়ে রেখেছিল তাদের যদি রণক্ষেত্রে হারানো যায় সেটা তো অতি প্রণিধানযোগ্য নিশ্চয়ই। ক্রিকেট ঠিক একই কাজ করেছিল উনিশশো একাত্তর-য়ে। যা ছিল বৃহত্তম সংস্কারের সোপান। তাই তো রেনেসাঁ। তাই এই বই।'
আবার উপসংহার-এর এক জায়গায় গৌতম লিখছেন, 'আমরা যারা সেই সময় বড় হচ্ছি তাদের কাছেপিঠে এমন কেউ হাজির ছিল না যাকে দেখে উদ্দীপ্ত হওয়া যায়। খুব ধূসর একটা সময়। কাগজ খুললে কেবল বেকারিত্ব আর দারিদ্র্যের খবর। বাংলাদেশ অশান্ত হয়ে রয়েছে বলে এপারেও জারি ছিল ভয়ার্ত সব চিন্তা। ওয়াড়েকরের ভারতীয় দল যখন ইংল্যান্ডে খেলছে তখন তো এখানে পাড়ায়-গলিতে আলোচনা যুদ্ধ লাগল বলে। সমান্তরালভাবে তীব্রতর হচ্ছিল নকশাল আন্দোলন। এদিক-ওদিক খুনোখুনি। পাইপগানের নিষ্ঠুর শব্দ। অদ্ভুত একটা অনিশ্চয়তা আর ভয় ভয় ভাব তখন পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে। ধর্মঘটের মারাত্মক চল। বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল অনেক কলকারখানা। অভিজাত বাঙালি পাড়ায় বসবাস করেও প্রতি মুহূর্তে কেমন নিরাপত্তাহীনতার অভাব অনুভব করতাম। ওয়াড়েকরদের কীর্তি এই আবহে বুঝতে হবে।'
দুটোই একেবারে খাঁটি জাজমেন্ট।
আর ওরকম অদ্ভুত অনিশ্চয়তা আর নিরাপত্তাহীনতার যুগে রেনেসাঁম্যান হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি--- সুনীল গাভাসকর।
এই বইয়ের পনেরোটা অধ্যায়ের ভেতর সবচেয়ে কাঙ্খিত অধ্যায়----'দ্য নেম ইজ গাভাসকর' নিয়ে কিছু বলার আগে কয়েকটা অন্য কথার অবতারণা বোধহয় আবশ্যক। ওয়াড়েকর এবং তাঁর পরিচালিত টিমের টানা তিন সিরিজের সাফল্যের রোম্যান্স যেমন অনন্ত। তেমনই তার ভেতরের পঞ্জিভূত বিষাদ, রক্তক্ষরণ, যন্ত্রণাও চিরন্তন সত্য। অস্বীকারের কোনও উপায় নেই। 'গাভাসকরের জন্ম'-র ক্ষেত্রেও সেটা যেন কেমন অদ্ভুতভাবে প্রযোজ্য। বইয়ের একদম গোড়ার দিকের একটা পাতায় বড় বড় অক্ষরে লেখা---- একদিকে অভিনবত্ব, ঋজুতা, সাহস, সংকল্প, অনমনীয়তা, আত্মত্যাগ, মধ্যবিত্ততা। একদিকে অবিশ্বাস, সংঘাত, আনুগত্যহীনতা, বিশ্বাসঘাতকতা, সমালোচনা, রাজবংশ। এটা আসলে এককথায় সোনার সাফল্য পাওয়া ওয়াড়েকরের ভারতীয় দলের অন্তরমহল।
তেমনই একাত্তরের সোনার যুগ্ম সফর নিয়ে লেখা এই বইয়ের অন্তরমহলও যেন। একদিকে অসম্ভব রিসার্চ ওয়ার্ক, পুঙ্খানুপুঙ্খ সব বিবরণ নিখুঁতভাবে তুলে ধরা, অনবদ্য লিখনশৈলী, রোমহর্ষক কান্ডের হিমশীতল বর্ণনার ফাঁকেও চমৎকার হাস্যরসের আমদানি, পটৌডি-গাভাসকরের মতো অবিসংবাদী সুপারস্টারদের সম্পর্কে সুপার এক্সক্লুসিভ খবর প্রদান অর্ধশতাব্দী পরেও। আবার একদিকে করোনা-যুগে 'গাভাসকরের জন্ম'-র 'কনসিভ্' ঘটা, গোটা কোভিড-জমানা বইয়ের রচনাকাল, গৃহবন্দি লেখকদ্বয়, সিনিয়র লেখকের স্বয়ং কোভিডাক্রান্ত হওয়া, মাতৃবিয়োগের মতো মর্মান্তিক শোক সামলানো।
ক'জনই বা এই বই পড়ার আগে জানতেন প্রবাদপ্রতিম ফ্র্যাঙ্ক উলি-কে সিনিয়র পটৌডি ইফতিকার আলি খান নিযুক্ত করে গেছিলেন কিশোর ছেলের কোচ হিসেবে? উলি-ই মনসুর আলি খান পটৌডির আচরেকর। সুনীল গাভাসকরের জীবনের প্রথম প্রকৃত কোচ যে স্ট্যান্ড ওয়াদিংটন নামক এক ব্রিটিশ কোচ সেটাও বা 'গাভাসকরের জন্ম'-র আগে ক'জনের জানা ছিল? বলতে দ্বিধা নেই আমি অন্তত জানতাম না।
শুষ্ক পরিসংখ্যানের কচকচানি বেশি সরবরাহ করে এই বইকে ভারাক্রান্ত করা হয়নি বটে। কিন্তু আবার এমন পরিসংখ্যান রয়েছে' গাভাসকরের জন্ম'-য়ে যে তাক লেগে যায়। যেমন, একাত্তরে অভিষেক টেস্ট সিরিজে গাভাসকরের 774 রানের এখনও অক্ষত বিশ্বরেকর্ডের কথা তো ক্লাস ওয়ান-এর বাচ্চারও জানা। কিন্তু বলুন তো গাভাসকর যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের জন্য নির্বাচিত হলেন, তাঁর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে কত রান ছিল? এই বইয়ের লেখকদ্বয় জানাচ্ছেন, যে লোকটা বিশ্বের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে দশ হাজার টেস্ট রানের এভারেস্ট জয় করেছিলেন, তাঁর জীবনের প্রথম সফরের আগে প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ছিল 12 ইনিংসে 811 রান।
আরেকটা বিশেষত্ব এই বইয়ের---- কিছু কিছু ক্রিকেট-তীর্থের অসাধারণ ট্যুর গাইড লেখকদ্বয়ের কলমে উঠে আসাটা । সেটা টাইগার পটৌডির ক্রিকেট-দুর্ভাগ্যযাত্রা বোঝাতে গিয়ে হোক। বা, ভারতীয় ব্যাটিংয়ের প্রথম অবিসংবাদী সাম্রাজ্যর ঠিকানার খোঁজ দিতে গিয়েই হোক। অর্থাৎ, গাভাসকরের জীবনের প্রথম উনিশ বছর কাটানো বাসস্থানের বর্ণনায়। যেমন গৌতম-বোরিয়া জুটি লিখছে, 'সাউদাম্পটন হল সেই শহর যেখানকার বন্দর থেকে উনিশশো এগারো সালে টাইট্যানিকের ঐতিহাসিক দুর্ভাগ্যযাত্রা শুরু হয়। কিন্তু সেখানকার হ্যাম্পশায়ার কাউন্টির স্টেডিয়ামের কফিশপে বর্তমান ভারতীয় অ্যাটাকিং ক্যাপ্টেনের গুণগানে ব্যস্তদের প্রায় কেউই হয়তো জানেন না ভারতে অ্যাটাকিং ক্যাপ্টেনের জনকের ক্রিকেটশিক্ষা এখান থেকে মাত্র আধঘন্টা দূরের ছোট শহরে। উইঞ্চেস্টার। হ্যাম্পশায়ারের ক্যাথিড্রাল শহর। আইকনিক উইঞ্চেস্টার কলেজের প্রতিষ্ঠা চোদ্দোশো শতকে। উইঞ্চেস্টার এখনও ইংল্যান্ডের সবচেয়ে পুরনো পাবলিক স্কুল। সেই স্কুল যা জন্ম দিয়েছে যুগান্তকারী দুই ক্রিকেট ক্যাপ্টেনের। ডগলাস জার্ডিন ও টাইগার পটৌডি।'
কী অসাধারণ ক্রিকেট ট্যুর গাইড গৌতম-বোরিয়া জুটির কলমে উঠে এসেছে।
গাভাসকরের পুরনো বাড়ি পৌঁছনোর হদিশ তো এই বইতে লেখকদ্বয় যেভাবে দিয়েছেন তা একমাত্র ক্রিকেট রোম্যান্টিকের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব। আর এঁদের জুটি তো অমোঘ---- ক্রিকেট ঐতিহাসিক ও ক্রিকেট রোম্যান্টিকের। যে জুটি লিখেছে, 'সত্তর-আশি দশকের বলিউড ফিল্ম যদি দেখেন, হাজি আলি দরগার কোনও দৃশ্য থাকবেই। সমুদ্রের মধ্যে দুধসাদা রঙের দরগাটা মুম্বই ঘুরতে আসা মানুষ ঘুরে আসবেনই। আপনি যদি ক্রিকেট রোম্যান্টিক হন এবং এলাকাটা ছাড়িয়ে মিনিটদশেক গাড়িতে যেতে রাজি থাকেন, অন্য ধরনের দরগা আপনার প্রতীক্ষায় থাকবে। হাজি আলি দরগা ক্রসিং থেকে রাস্তার বাঁদিকে যদি কিছুদূর যাওয়া যায়, প্রথমেই নজরে পড়তে বাধ্য ভাটিয়া হাসপাতাল। হাসপাতাল থেকে একটু এগোলেন কিনা একটা রাস্তা এসে পড়বে---তুকিরাম জাওজি মার্গ। এখান থেকে যে মধ্যবিত্ত অঞ্চলটার বিস্তৃতি তার নাম চেকলওয়াড়ি। কোনার বাড়িটা প্রায় রাস্তার ওপর। ভাগীরথী কো-অপারেটিভ সোসাইটি। বিশাল না হলেও মোটামুটি বড় কো-অপারেটিভ। যার ভেতর আজও চব্বিশটা পরিবার। পুরনো এই বিল্ডিংটা প্রত্যেক ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীর জন্য অপরিহার্য। ভারতীয় ক্রিকেটে সত্তর মিমি প্রোজেকশনের মতোই বিশাল, চোখধাঁধানো একটা ব্যাপার। ভারতের সর্বকালের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যানের আদি আস্তানা।'
এক ঐতিহাসিক হদিশের কী অপরূপ বর্ণনা।
সত্যিই বন্ডের ভাষা ধার করা ছাড়া অন্য উপায় ছিল না লেখকদ্বয়ের--- দ্য নেম ইজ গাভাসকর। সুনীল গাভাসকর।
সেই সুনীল গাভাসকর যাঁর শুরু 774 রানের আলোড়ন জাগিয়ে। আর শেষ বেঙ্গালুরুর খোঁয়াড় উইকেটে 96 রানের অমর ইনিংস খেলে। চমৎকার লিখেছেন লেখক জুটি, 'মানুষটার শেষ করার স্টাইলটা জাস্ট ভাবা যাক। শেষ পাঁচদিনের ম্যাচে 188। শেষ টেস্ট ইনিংস 96। শেষ করার আগের ওয়ান ডে-তে সেঞ্চুরি। জীবনের শেষ টেস্ট ইনিংসেও এমন কনসানট্রেশন নিয়ে ব্যাট করেন যে, করমর্দনের দূরত্বে ক্লোজ-ইন পজিশনে ফিল্ডিং করা জাভেদ মিয়াদাদের করা স্লেজিং-গালাগালের একটাও গাভাসকরের কানে ঢোকেনি। স্বয়ং মিয়াদাদ তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন। বাইসেন্টিনারি টেস্টের আগের প্রস্তুতি ম্যাচে ব্যাকল্ফিটের সামান্য ভুলচুকে শূন্য-তে আউট হয়েছিলেন গাভাসকর। পরের দিন আয়নার সামনে খালি গায়ে গাভাসকরের দু'ঘন্টা ধরে চলেছিল ব্যাক লিফট্ প্র্যাকটিস। গ্রেটনেস আর কী হতে পারে যে, কোনও মানুষ টেস্টে দশ হাজারের বেশি রান আর চৌত্রিশ সেঞ্চুরির পরেও খালি গায়ে আয়নার সামনে দু'ঘন্টা প্র্যাকটিস করতে রাজি। গাভাসকরের পুরনো ফ্ল্যাটে পৌঁছতে তিনতলা হেঁটে উঠতে হবে। লিফট্ তখনও ছিল না, আজও নেই। তবে এখনও কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলে ক্রিকেট অনুরাগী নির্ঘাত অলক্ষ্যে লর্ড রিলেটরের পঞ্চাশ বছর আগে রেকর্ড করা ক্যালিপসো শুনতে পাবে,
নট অ্যাট অল
নট অ্যাট অল
ইউ নো ওয়েস্ট ইন্ডিজ কুড নট আউট
গাভাসকর অ্যাট অল।
ব্র্যাডম্যানের যেমন বাউরাল। গাভাসকরের তেমন ভাগীরথী। ইয়েস্, বয় ফ্রম চেকলওয়াড়ি নয়। বয় ফ্রম ভাগীরথী।'
'গাভাসকরের জন্ম'-র লেখকদ্বয়ের দাবি সর্বৈব ন্যায্য যে, যদি সিনেমামোদিরা মেহবুব স্টুডিওতে গিয়ে আজও' মুঘলে আজম'-এর কোথায় সেট পড়েছিল সরেজমিন দেখেন, তাহলে ভাগীরথী বিল্ডিংই বা কেন কন্ডাক্টেড্ ট্যুর করানো সম্ভব নয়। কেবল বোঝাবার জন্য যে, কো-অপারেটিভের নীচে ওই লম্বা ষাট-পঁয়ষট্টি গজের সোজা বিস্তৃত এলাকাই ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে বিখ্যাত স্ট্রেট ড্রাইভের জন্ম দিয়েছিল।
রেনেসাঁম্যান গাভাসকরের পাশাপাশি এই বইয়ে অনন্যসুন্দরভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে বিস্মৃত তাঁর সহনায়কদের। দিলীপ সারদেশাই : ইনোসেন্ট ভারতের প্রতিমূর্তি।। সেই অমলিন ভারত যা হৃষিকেশ মুখার্জির ফিল্মে উঠে আসত। সারদেশাইয়ের মধ্যেও একটা নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের ইন্ডিয়াকে আবিষ্কার করা যেত যা কখনও হাঁকপাক করছে না, শশব্যস্ত নয় অথচ নিজস্ব একটি জাতীয়তাবাদ বহন করে চলেছে।
একনাথ সোলকার ও আবিদ আলি : এঁরা ভারতীয় দলের উত্তম-সৌমিত্র ছিলেন না। দলের প্রথমসারিতে থাকা দু'তিনটে ঝকঝকে গ্ল্যমারাস মুখের মধ্যে নয়। কিন্তু ভারতীয় দলের যেকোনও ফাটাফুটো ঠিকঠাক করতে, চাপের মুখে, দুর্ভাবনার মুখে এঁরা। সোলকার ও আবিদকে তখনকার বাংলা সিনেমার ভানু-জহর বলা যায়। যাঁরা যেকোনও দুর্বল চিত্রনাট্য উতরে দিতে পারতেন। গ্ল্যমারাস না হতে পারেন, বক্স অফিসের জন্য ভীষণ প্রয়োজনীয়।
একাত্তরের সোনার যুগ্ম সফর শেষে তৎকালীন জাতীয় নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান বিজয় মার্চেন্ট যদি সারদেশাইকে বলেন, 'ভারতীয় ক্রিকেট নবজাগরনের মুখ।' তাহলে সেই টিমের ক্যাপ্টেন ওয়াড়েকর বলেছিলেন গাভাসকরকে----'ভারতীয় ক্রিকেটের রাজ কাপূর।' ওয়াড়েকর স্বয়ং কী? ভারতীয় ক্রিকেটের ট্র্যাজিক হিরো?
অর্ধশতাব্দীর পুরনো ভারতীয় ক্রিকেট গৌরবগাথা লিখতে বসে এই বইয়ে বারেবারে আধুনিক ভারতীয় ক্রিকেটকে সঙ্গত কারণেই টেনে এনেছেন গৌতম-বোরিয়া লেখকজুটি। একটার জায়গায় দুটো চোখ থাকলে কি পটোডি সচিনের আগের সচিন হতেন? সিকে নাইডুর ইচ্ছেমতো মারা বিশাল ছক্কাগুলো কি তাঁকে ধোনির আগের ধোনি বলবে? আবিদ আলির মতোই কি 'ইউটিলিটি' প্লেয়ার আজকের রবীন্দ্র জাডেজা?
কিন্তু ওয়াড়েকরের অধিনায়ক হিসেবে অমন রোমাঞ্চকর শুরুর তিন বছরের মধ্যেই অবিশ্বাস্য পতনের কোনও তুলনার যেন খোঁজ নেই। তাঁর পরিচালিত টিমও তাই।। অনন্ত রোম্যান্স দিয়ে শুরু, বিষাদের আগুনে শেষ। উনিশশো চুয়াত্তরের চোরাকাঁটায় ক্ষতবিক্ষত তাঁর পরিচালিত টিমের চেয়েও অনেক অনেক বেশি স্বয়ং ওয়াড়েকর। ধোনি তো বিশ্বকাপ জেতার পরপর দুটো টেস্ট সিরিজে 0-4, 0-4 হারলেও তাঁর ক্যাপ্টেন্সি দিব্যি ছিল।
তাই একদম খাঁটি কথা বলেছেন এই বইয়ের যুগ্ম লেখক----- 'লাকি ক্যাপ্টেন তো ননই। অজিত ওয়াড়েকর বরং আনলাকিয়েস্ট ক্যাপ্টেন। ভারতের সর্বকালের সবচেয়ে দুর্ডাগা নেতা।
আর এখানেই ' গাভাসকরের জন্ম'-র বৃহত্তম মোচড়।
- সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
Boria Majumdar
Gautam Bhattacharya
Publisher : Deep Prakashan
Author : Boria Majumdar, Gautam Bhattacharya
Language : Bengali
Binding : Hardcover
Pages : 302
ISBN : 9789389983401