Classic
কলকাতা শহর থেকে খুব কাছেই একটা জায়গা। আপাতদৃষ্টিতে শহর থেকে এতো কাছে হলেও সেটা গণ্ডগ্রাম। পথগুলো গ্রীষ্মে-শীতে ধুলোর সাগর আর বর্ষায় হাঁটু সমান কাদা নিয়ে এঁকেবেঁকে চলে যায়। এই পথেরই পাশে কোথাও, অনেক গাছপালায় ঢাকা এক খণ্ড জমি। এখানে এলে মনে হবে যেন সূর্যের আলো কখনও প্রবেশ করে না। ভ্যাঁপসা গরমে দম বন্ধ হয়ে আসবে। এবং তখনই নিশ্চিত হতে পারবেন যে আপনি শ্যামা ঠাকরুনের বাড়িতে এসেছেন।
অনেকখানি জায়গা নিয়ে শ্যামা ঠাকরুনের বাড়ি। আর সেই বাড়ির চারপাশে এক বিঘৎ জমিও সে খালি রাখেনি। সব জায়গায় ঠেসে লাগানো গাছপালা। কিন্তু তাতে ফল ধরে না। সূর্যের আলো পায় না বলে গাছের ফলন নেই। কিন্তু বৃদ্ধা শ্যামা তা বুঝতে চান না। মনে মনে ভগবানের কাছে অভিযোগ জানায় শুধু। কত বয়স হল শ্যামার? আশি? হবে হয়ত। তার বয়সের গাছপাথর হিসেব করার কেউ নেই এখন। ছিটগ্রস্ত এই বৃদ্ধা এখন একাকি এক বিশাল বাড়িতে বাস করেন। ছেলে মেয়ে সব দূরে। দিনের বেলায় শ্যামা পাতা কুড়ান আর রাত কাটে নির্ঘুম। রাতে সে ভাবে তার অতীত।
শ্যামার মা রাসমনি। তার চৌদ্দ বছর বয়সে বিয়ে হয়। গঙ্গার ঘাটে রাসমনিকে দেখে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ জমিদারের উদ্বেল হৃদয়ের ফলাফল তার বিয়ে। বৃদ্ধ জমিদার মানুষটা ভালো ছিল। তরুণী ভার্যাকে ভালবাসত। কিন্তু সে বেঁচে রইল না বেশিদিন। আর জ্ঞাতিরা রাসমনির নামে কলঙ্ক তুলে বের করে দিলো ঘর থেকে। স্বামীর ভালবাসার উপহার গয়নাগুলো সম্বল করে রাসমনি কলকাতায় এলেন। এখানেই একা হাতে মানুষ করতে শুরু করলেন তিনটি মেয়ে। কমলা,শ্যামা আর উমা।
একা যুবতী রাসমনি বাস করেন কলকাতায়, তিনটি মেয়ে নিয়ে। কিন্তু তাই বলে তাকে গঞ্জনা খুব একটা সহ্য করতে হয়নি। কারন দুটো। প্রথমত তার ব্যক্তিত্ব, দ্বিতীয়ত পড়শিদের সাথে কখনও মিশতে যাননি। একা একাই থেকেছেন ভাড়ার বাড়িতে। বড় মেয়ে কমলাকে বিয়ে দেন। সোনার জামাই তার। মেয়ে সুখেই থাকে। এমন সময় ঘটকী আসে শ্যামার বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে। খুব একটা খোঁজ খবর না করেই শ্যামাকে বিয়ে দেন রাসমনি।
শ্যামার গল্প শুরু হয় এখান থেকেই।
গজেন্দ্রকুমার মিত্র দেখিয়েছেন সময়ের সাথে মানুষের বদলে যাওয়া। বেঁচে থাকার জন্য তাদের সংগ্রাম। মনের কুৎসিত দিক আর সৌকুমার্যের দ্বন্দ্ব। ‘কলকাতার কাছেই’ যে এমন কিছু ঘটনা এমন কিছু পরিবার থাকে তা মানুষের চোখে পড়েও পড়েনি। পড়লেও তাদের ঘরের খবর কে জানত…? এমনই একটি পরিবারের কথা তুলে এনেছেন তিনি আমাদের সামনে। যা আমাদের একটা সময়ের কথা বলে। কিছু মানুষের কথা বলে। আর তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রামের কথা বলে।
Gajendrakumar Mitra