Hardcover, Baidurya Sarkar, Historical Novel
মোহনলাল বাঙালির সেই পার্শ্বচরিত্র, যে মাঝে-মাঝে অতিক্রম করে যায় নায়ককে। অদৃশ্য পরিচালক তার ডানা গল্পের মাঝে ছেঁটে দেন। বাঙালির ঘরে তাই চিরকাল লুকিয়ে থাকে হতোদ্যম মোহনলালদের গল্প। বারবার যে উঠে দাঁড়ায় আবার নিয়তির ঘা খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
নিজের লোককে ছেড়ে বিদেশিদের সাহায্য করা মিরজাফর বা লোভী রায়দুর্লভ জগৎশেঠ এখনও ঘরে-ঘরে আছে। হেরো অবিবেচক নায়ক সিরাজ, প্রাণ দিয়ে নিজের জীবন ধন্য করা মিরমদনদের দু’-চারটে নমুনা পাওয়া যাবে সব যুগেই। শুধু সহজে মেলে না মোহনলাল। নামে-বেনামে বদনামে সে একজন হয়েও বহু মানুষের সমান। ইংরেজরা তাকে সহ্য করতে পারত না, রণদুর্মদ ক্লাইভ যদিও তাকে যুদ্ধের আগে দলে টানতে চেয়েছিল। জগতের সবচেয়ে বড়োলোক শেঠরা তাকে ধাপ্পা দিতে পারেনি। মিরজাফর স্বয়ং এড়িয়ে চলেছে তাকে।
পলাশির প্রান্তরে অন্যদের প্ররোচনায় শিবির থেকে নবাব সিরাজের বারংবার যুদ্ধবিরতির ঘোষণায় শেষমেশ ছাউনিতে ফিরে আসা বিরক্ত মোহনলাল হয়তো বুঝে গেছিল, তাকেই নতুন করে শুরু করতে হবে লড়াই। এই বিভ্রান্ত নবাবের ওপর ভরসা করা যায় না বিশেষ।
কাব্যকাহিনিতে রাজার থেকে সেনাপতি বা মন্ত্রীর নাম বেশি হয়ে গেলে যেমন গল্প মার খায়, তেমন নবাবের থেকে তার দেওয়ানের অধিক ক্ষমতা ভালো নয়। এই জন্যেই হয়তো মোহনলালকে ছাড়তে হয়েছিল সব। তবু সে নেভেনি। ফিরে ফিরে এসেছে। জনশ্রুতিতে ভেসে উঠেছে তার নাম। কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই মানুষ বিশ্বাস করেছে তার কথা।
জীবনের অন্তিম লগ্নে সিরাজ ভেবেছিল, সৈন্য সংগ্রহ করে আবার যুদ্ধ করবে ইংরেজদের সাথে। এ-জন্মে না হোক, পরজন্মে! সিরাজের পরজন্মের কথা জানা নেই, তবে সেই জন্মেই মোহনলাল ইংরেজদের সাথে লড়েছিল ভবানী পাঠক রূপে। সে-খবর সবাই মানতে না চাইলেও কিছু পরিবার জানত বংশানুক্রমিকভাবে। যাদের পরিচিতি ছিল মূলত মোহনলালের অধীনে থাকা বিশ্বস্ত সেনা হিসেবে।
মহারাজ উপাধি পাওয়া মোহনলালের অধীনে ছিল বেশ কিছু সৈন্যসামন্ত ও সেনাপতির দল। তারা পলাশির যুদ্ধের পর কর্পূরের মতো উবে গেছিল? অন্তত ঘটনার পরম্পরা দেখে তেমনই মনে হয়। অনেকে বলে তারা ছদ্মবেশে ফিরে এসেছিল সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহের সময়। তবে তার পাথুরে প্রমাণ মেলে না তেমন। পুরোটাই হয়তো অনুমান। সেইসব বংশের পরবর্তী প্রজন্মের লোকেরা সময়ের সঙ্গে ক্রমে মিশে গেছে আমজনতার ভিড়ে। অবশ্য গুহ্যকথার মতো সে লুকোনো পরিচয় সমাজের মাথা-লোকেরা কেউ-কেউ অনেকদিন জানত। তবে সে-সব কথা সময়ের দীর্ঘ পরিক্রমায় চাপা পড়ে যায়। মোহনলালের বৈধ বংশধরদের নাম ইতিহাসে থেকে গেছে। তবে বর্তমানে তাদের উত্তরাধিকারীর বিশেষ খোঁজ মেলে না। মিললেও তাদের সাথে বাঙালির সম্পর্ক ঘুচে গেছে ক’প্রজন্ম আগেই ।
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধের পর থেকে ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে ভবানী পাঠকের জীবনাবসান— এই দীর্ঘ তেত্রিশ বছর মোহনলাল বা তার সঙ্গে থাকা সৈন্য-সেনাপতিরা কি ঘরে ফেরেনি? তাদের বংশধররা কি সত্যিই হারিয়ে ফেলেছে সে-সব দিনের স্মৃতি? তাদের সাথে মিশে থাকা দেবী চৌধুরাণী কি বঙ্কিমের গল্পের মতো সত্যিই ফিরে আসতে পেরেছিল তার পূর্বতন সংসারে? তখন কোনও বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারে ঘর ছেড়ে পথে পা বাড়ানো মেয়ের পক্ষে সেটা এতই স্বাভাবিক ছিল! সাধারণ যুক্তিতে উত্তর হয়— ‘না’।
এসব নানারকম খোঁজ করতে করতেই বেরিয়ে আসে সেই যুগের উল্লেখযোগ্য যোদ্ধার বংশধারা বহন করা একটি পরিবারের কাহিনি। যাদের নাম ইতিহাসে নেই কোথাও। তবু বিশেষ কিছু পারিবারিক রীতিনীতি ও গল্পগাছা তারা বহন ও ধারণ করে চলেছে আজও।
Others